-

মোবাইল নেটওয়ার্কের বিবর্তন:১৪ কেবিপিএস থেকে ১জিবিপিএস পর্যন্ত | Evolution of mobile networks

মোবাইল ফোন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু। এটি দ্বারা আমরা কথা বলতে পারি, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি, ইন্টারনেট থেকে গান, ভিডিও বা সিনেমা নামাতে পারি। অবশ্য সব মোবাইল দ্বারা এসব কাজ করা যায় না। মোবাইল ফোনের প্রকারভেদে এর কাজের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সব মোবাইলের মধ্যে একটা কমন ব্যাপার হলো এর নেটওয়ার্ক সিস্টেম। নেটওয়ার্ক কানেকশন ছাড়া অনেক ফোনে কিছুই করা যায় না। নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে হলে আমাদের অবশ্যই একটি সিম(SIM-Subscriber Identity Module) কার্ড/ওয়াই ফাই সুবিধা দরকার হবে। অবশ্যই যেই কোম্পানির সিম কিনবো ওই কোম্পানিই আমাদের নেটওয়ার্ক প্রদান করবে এবং আমরা দুর থেকে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। এখন যেই মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করি তা হলো তারবিহীন মাধ্যম। ওয়াই ফাই এর ক্ষেত্রে ভিন্ন হিসেব। সেখানে তার দিয়ে লাইন টেনে নির্দিষ্ট একটি এরিয়াতে রাউটার দিয়ে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস দেয়া হয়। তাড়িতচুম্কব তরঙ্গ ব্যাবহার করে এটি তথ্য আদান প্রদান করে।



যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারবিহীন মাধ্যম আবিষ্কারের আগে মানুষ টেলিফোনে কথা বলতো। যেখানে টেলিফোনের সাথে সবসময় একটি তার যুক্ত থাকতে হতো। এই পদ্ধতির প্রধান সমস্যা টেলিফোনটি বহন করা যায় না। যেকোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে সবসময় যোগাযোগ করতে হয়। অতএব তারবিহীন যোগাযোগ মাধ্যম আবিষ্কার যে আমাদের জন্য কতটা আশীর্বাদের তা আমরা বুঝতেই পারছি। প্রথম দিকে এই মাধ্যমে শুধুমাত্র কথাই বলা যেত। কিন্তু এখন শুধু কথা বলা ছাড়াও আরো এমনসব কাজ করা যায় যা একসময় কল্পনারও বাইরে ছিল। ইন্টারনেট আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। কিন্তু আজকাল কজনই বা তারযুক্ত সিস্টেমে ইন্টারনেট ব্যাবহার করে?? আমরা সবাইই এখন তারবিহীন নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে ইন্টারনেট ব্যাবহার,কল করা,ভিডিও কলিং,মুভি/গান ডাউনলোড,অনলাইন চ্যাটিং ইত্যাদি কাজ করে থাকি।

যাই হোক আমাদের আলোচনার মুল বিষয় ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক নয় বরং মোবাইল টেলিফোনের ক্ষেত্রে এই নেটওয়ার্কের বিবর্তন। প্রথমদিকে এটি অত্যন্ত ধীরগতির থাকলেও এখন এই নেটওয়ার্ক অত্যন্ত দ্রুত এবং কার্যকরী। আমরা এই বিবর্তন নিয়েই আলোচনা করবো। প্রথমেই এ সম্পর্কে কিছু ব্যাসিক ধারনা নিয়ে নেই তা হলো মোবাইল টেলিফোনে প্রথম ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার শুরু হয়েছিলো ১৯৮০ সালে আমেরিকাতে।বানিজ্যিকভাবে প্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯১।এতে একটি কোম্পানি থাকে যারা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে নিজেদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়।তাদের নিজস্ব একটি সিম কার্ড থাকে।যখন কোনো ব্যাবহারকারি এই সিমটি তার মোবাইলে ঢুকান তখন তিনি যদি নেটওয়ার্ক এরিয়ার ভিতরে থেকে থাকেন তাহলে তিনি নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।বিনিময়ে তিনি ওই কোম্পানিকে টাকা প্রদান করেন।

চিত্র:একটি নেটওয়ার্ক প্রদানকারী টাওয়ার।

তারিতচুম্বক তরঙ্গের মাধ্যমে যেটি ব্যাবহারকারীর মোবাইলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তা ছড়িয়ে দেয়। মোবাইল নেটওয়ার্কের বিবর্তনকে কয়েকটি জেনারেশন বা প্রজন্মে ভাগ করা হয়েছে।যেমন 1G,2G,3G এরকম।এখন আমরা এই জেনারেশনগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

1G বা প্রথম প্রজন্ম: প্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি যেটি ১৯৮০ সালে আমেরিকাতে প্রথম চালু হয়। AMPS(Advanced Mobile Phone Technology) ব্যাবহার করে এই যোগাযোগ মাধ্যমটি স্থাপিত হয়। এই প্রজন্ম :

  • সর্বপ্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। অবশ্যই তারবিহীন।
  • ডেটা আদান প্রদানের গতি-2.4 kbps থেকে 14.4 kbps.
  • সুবিধা:শুধুমাত্র কথা বলা যেত।
  • কোনো ইন্টারনেট সুবিধা ছিল না।
  • প্রযুক্তির ধরন-অ্যানালগ প্রযুক্তি।
চিত্র:একটি প্রথম প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা মোবাইল ফোন।

2G বা দ্বিতীয় প্রজন্ম: 1G এবং 2G’র মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো 1জি ছিলো অ্যানালগ পদ্ধতির এবং 2জি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তির। অ্যানালগ এবং ডিজিটালের মধ্যে পার্থক্য হলো-অ্যানালগ পদ্ধতিতে একটি ডিভাইসে কোনো তথ্যকে সংগ্রহ করে সরাসরি গ্রাহক ডিভাইসে পাঠানো হয় বিদ্যুত সিগন্যাল হিসেবে।কিন্তু ডিজিটালে ওই তথ্যকে সংগ্রহ করে প্রথমে কম্পিউটারের ভাষায় রুপান্তর করা হয় এবং নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা আকারে গ্রাহক ডিভাইসে পাঠানো হয় তারিতচুম্বক তরঙ্গ হিসেবে।

অ্যানালগ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে সুবিধা অসুবিধা হলো-

১। অ্যানালগ পদ্ধতি ডিজিটাল পদ্ধতির তুলনায় বেশি ব্যায়বহুল।
২।অ্যানালগ পদ্ধতিতে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না,ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য নিরাপদ(Encrypted) থাকে।
৩।মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রে অ্যানালগ সিস্টেমে ক্রস কানেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কিন্তু ডিজিটালে ক্রস কানেকশন হয় না।

চিত্র:অ্যানালগ এবং ডিজিটাল যন্ত্রের উদাহরণ।

অ্যানালগে যন্ত্রটি সরাসরি যান্ত্রিকভাবেই ফলাফল প্রকাশ করে কিন্তু ডিজিটালে সেটি সংখ্যা দ্বারা ফলাফল প্রকাশ করে। তো আমরা অ্যানালগ এবং ডিজিটাল সম্পর্কে বুঝলাম। এখন আবার 2জি প্রযুক্তিতে ফিরে আসি। ফিনল্যান্ডের রেডিওলিনজা কোম্পানির মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম 2জি প্রযুক্তি উদ্বোধন করা হয়। এ প্রযুক্তি ওয়্যারলেস যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুবিধা পাওয়া যায়। এ প্রজন্মের নেটওয়ার্কে যে যে নতুন সুবিধা যুক্ত হয় :

  • ব্যাবহৃত প্রযুক্তি:-GSM(Global System For Mobile Communication)
  • ডেটা আদান প্রদানের স্পিড-সর্বোচ্চ ৫০কেবিপিএস।
  • SMS, MMS, ইন্টারনেট সুবিধা, উন্নত ভয়েস কল।
  • EDGE: 2Gর উন্নত ভার্শন। এই পদ্ধতিতে ডেটা স্পিড সর্বোচ্চ 1mbps পর্যন্ত উঠতে পারে।

3G বা তৃতীয় প্রজন্ম: তৃতীয় প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। সর্বপ্রথম 3জি চালু হয় জাপানে ২০০১ সালে। নকিয়া ৬৬৩০ ছিল প্রথম মোবাইল ফোন যা 3জি, Edge এবং 2জি নেটওয়ার্কে চলতে সক্ষম।

চিত্র:নকিয়া ৬৬৩০ মোবাইল ফোন।

3জির চালু মোবাইল নেটওয়ার্ক সিস্টেমে বিপ্লবের সৃষ্টি করে। ইন্টারনেট ব্যবহারের চাহিদা বাড়তে থাকলে 3জির চাহিদাও বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম 3জি চালু হয়। থ্রিজি চালু করা প্রথম বাংলাদেশী অপারেটর হলো টেলিটক।

এ প্রজন্মের নেটওয়ার্কের সুবিধাসমুহ:-

  • ব্যাবহৃত প্রযুক্তি:WCDMA,IMT 2000,HSPA,HSPA+
  • ডেটা আদান প্রদানের স্পিড:384kbps থেকে 7.2 mbps.HSPA+ এর জন্য 21mbps.
  • ভিডিও স্ট্রিমিং,হাই স্পিড ফাইল ডাউনলোডিং,ভিডিও কলিং।
চিত্র:HTC Corp’s EVO.বিশ্বের প্রথম ফোরজি স্মার্টফোন।

4G বা চতুর্থ প্রজন্ম: বর্তমান অবস্থার সবচেয়ে দ্রুতগতির ওয়্যারলেস মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। ২০০৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ২০০৯ সালে দক্ষিন কোরিয়াতে সর্বপ্রথম 4জি চালু হয়। ফোরজি প্রযুক্তি 3জি প্রযুক্তির থেকে ২৫০ গুন উন্নত এবং ডেটা স্পিড অত্যন্ত বেশি। এইচ টি সি কোম্পানি সর্বপ্রথম ফোরজি স্মার্টফোন নিয়ে আসে। ২০১৮ তে বাংলাদেশে ফোরজি চালু হয়।

ফোরজি প্রযুক্তির সুবিধাসমুহ:-

  • ব্যবহৃত প্রযুক্তি:LTE(Long Term Evolution),Wi-MAX
  • ডেটা স্পিড-সর্বোচ্চ 50mbps,নরমালি 4-12mbps.
  • সুবিধা সমুহ:-হাই ডেফিনিশন ভিডিও স্ট্রিমিং,ভিডিও কলিং।

5G: এপর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। এটি এখনো উন্নয়নশীল পর্যায়ে রয়েছে।NGMN(Next Generation Mobile Network Alliance) 5জির পৃষ্ঠপোষকতা করছে।তাদের ধারনা ২০২০ সালের মধ্যেই বানিজ্যিকভাবে ফাইভ জি চালু হবে। বর্তমানের ফোরজির চেয়ে এটি কয়েকগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন।

ফাইভ জির সুবিধাসমুহ:-

  • ডেটা স্পিড প্রায় ১জিবিপিএস পর্যন্ত হতে পারে!! অর্থাত এক সেকেন্ডে একটি ফুল এইচডি(720p) মুভি ডাউনলোড হয়ে যাবে!!!
  • এক সাথে অনেক ইউজার ব্যাবহার করলেও এর ক্ষমতা কমবেনা। অর্থাত্ একসাথে অনেক ইউজারকে সার্ভিস দিতে পারবে।

উল্লেখ্য এইখানে শুধুমাত্র মোবাইল নিয়ে আলোচনা করলেও নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিগুলো কম্পিউটার বা ল্যাপটপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সর্বশেষ প্রকাশিত