-

মাদার তেরেসা: মানবসেবায় অনন্যপ্রাণ এক নারীর কথা

কোনো প্রাপ্তির আশা না করে সারাটা জীবন কি দরিদ্রদের ভাগ্যের উন্নয়নে কাটিয়ে দেওয়া যায়? যায় নিশ্চয়ই- অন্তত মাদার তেরেসা এমনই জীবন কাটিয়েছেন। আজ তার জন্মদিন। আলবেনিয় বংশদ্ভুত এই মহীয়সী নারী ১৯১০ সালের ২৬ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আনিয়েজ গঞ্জে বয়াজিউ।

মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি তার বাবাকে হারান। মা-ই বড় করেছেন তাকে, দিয়েছেন ধর্মীয় শিক্ষা। ছোটবেলায় মিশনারিদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে বড়োই ভালবাসতেন তেরেসা। ১২ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন একটি সংস্থায়। মায়ের সাথে আর তার কোনোদিন দেখা হয়নি।

ভারতে প্রথম আসেন তিনি ১৯ বছর বয়সে, ১৯২৯ সালে। বিভিন্ন সেবা দানকারী সংস্থা এবং মিশনারীতে কাজ করে যেতে থাকেন তিনি। একসময় দরিদ্রদের স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। স্কুলে পড়াতে তার ভাল লাগলেও কলকাতার দারিদ্র্যে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলেন। ঐ সময় এক দূর্ভিক্ষে শহরে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ আর মৃত্যু, ১৯৪৬ সালে ভারত বিভক্তির আগে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় বহু মানুষ মারা যায়। এই সব ঘটনা তেরেসার মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

১৯৪৮ সাল থেকে তিনি পোশাক হিসেবে নীল পারের সাদা সুতির কাপড় পরা শুরু করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে একটি ছোট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন, তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে থাকেন। প্রথম দিকের এই দিনগুলো তার জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। এ নিয়ে ডায়রিতে অনেক কিছুই লিখেছেন তেরেসা। সে সময় তার হাতে কোন অর্থ ছিল না। গরীব এবং অনাহারীদের খাবার ও আবাসনের অর্থ জোগাড়ের জন্য তাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো, ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হতো। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই হতাশা, সন্দেহ ও একাকিত্ব বোধ করেছেন।

১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের দেয়া জমিতে মুমূর্ষুদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এই কেন্দ্রে যারা আশ্রয়ের জন্য আসতেন তাদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হতো এবং সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণের সুযোগ করে দেয়া হয়। মুসলিমদেরকে কুরআন পড়তে দেয়া হতো, হিন্দুদের গঙ্গার জলের সুবিধা দেয়া হতো আর ক্যাথলিকদের প্রদান করা হতো লাস্ট রাইটের সুবিধা। এর কিছুদিনের মধ্যেই তেরেসা কুষ্ঠরোগে আক্রান্তদের জন্য একটি সেবা কেন্দ্র খোলেন যার নাম দেয়া হয় শান্তি নগর। এছাড়া মিশনারিস অফ চ্যারিটির উদ্যোগে কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই কেন্দ্রগুলোতে ঔষধ, ব্যান্ডেজ ও খাদ্য সুবিধা দেয়া হয়। তেরেসা শিশুদের জন্য একটি আলাদা হোম তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই অনুভূতি থেকেই ১৯৫৫ সালে নির্মল শিশু ভবন স্থাপন করেন। এই ভবন ছিল এতিম ও বসতিহীন শিশুদের জন্য এক ধরণের স্বর্গ।

১৯৭৯ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালে তাকে দেওয়া হয় ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’। ১৯৯৭ সালে যখন তার মৃত্যু হয় তখন মাদার তেরেসার মিশনারিস অফ চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল চার হাজার, এর সাথে ৩০০ জন ব্রাদারহুড সদস্য ছিলেন আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১ লাখের উপর। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০টি মিশনের মাধ্যমে চ্যারিটির কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এসব মিশনের মধ্যে ছিল এইড্‌স, কুষ্ঠরোগ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়।

‘মাদার তেরেসা’ আজীবন আমাদের মনুষ্যত্ব শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘আমি সৃষ্টিকর্তার পেন্সিলের মতো, এই পেন্সিল দিয়ে চিরদিন আমি মানুষকে ভালোবাসার গল্প লিখে যাবো’। আমরা হয়তো কেউই মাদার তেরেসা হতে পারবোনা তবে তার দেখানো পথে কিছুটাতো চলতে পারবো…

লেকখ : Rumel M S Pir

সর্বশেষ প্রকাশিত