-

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর:মহাকাশের মহাবিস্ময় পর্ব:২

ভূতত্ত্ববিদ জন মাইকেল ক্যভেনডিসকে লেখা এক চিটিতে সর্ব প্রথম ব্ল্যাকহোলের ধারনা দেন ১৭৮৩ সালে।১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারনা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব।একই সালে কার্ল সোয়ার্জস্কাইল্ড দেখান যে যেকোনো নক্ষত্রই ব্ল্যাকহোলে পরিনত হতে পারে।১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম নভোচারীরা ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার করেন। গত পর্বে আমরা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির জন্য দায়ী মহাকর্ষ সম্পর্কে জেনেছি।বিপুল পরিমাণ মহাকর্ষের জন্য কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হয়। এখন প্রশ্ন হলো এত বেশি মহাকর্ষ ব্ল্যাকহোল পায় কোথা থেকে??কিভাবেই বা তার ভর এত বেশি হয়??এই পর্বে আমরা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির রহস্যগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।



সবার প্রথমে বলে নেই-ব্ল্যাকহোল মুলত মৃত নক্ষত্র থেকে সৃষ্টি হয়।একটি নক্ষত্র যখন তার সম্পুর্ন জালানি শেষ করে ফেলে তখন সেটি আর শক্তি বিকিরণ করে না।তখন সেটি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে চুপসে যেতে থাকে।যখন নক্ষত্রটি একেবারেই চুপসে যায় তখন এর ভর একই থাকে কিন্তু আকার হয়ে যায় খুবই কম।যেহেতু মহাকর্ষ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে আকার বা আয়তনের মতো নয়,তাই এটি আকারে ছোট হলেও এর মহাকর্ষ হয় অনেক বেশি।তাই স্থান-কালের বক্রতাও হয় অনেক বেশি গভীর। আর যদি এই বক্রতার গভীরতা শেষ পর্যন্ত গিয়ে একটি বিন্দুতে মিলিত হয় তাহলেই সেটি ব্ল্যাকহোলে পরিনত হয়।নিচের চিত্রটি খেয়াল করুন-

চিত্রটি ভালোভাবে খেয়াল করলেই আমরা বুঝে যাই কিভাবে বিশাল মহাকর্ষ একটি গভীর গর্তের মতো সৃষ্টি করে এবং কোন বস্তু যদি এর মধ্যে পড়ে তাহলে তা আর বের হতে পারে না।এমনকি আলোও না।একেবারে নিচের বিন্দুটি হলো ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র। এর সমস্ত ভর এখানেই জমাট থাকে।ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির শুরু থেকেই একই ভরের থাকেনা।এটি পরবর্তীতে অন্যান্য আশেপাশের জোতীষ্ক বা নক্ষত্র থেকে পদার্থ এর ভিতরে টেনে নেয় এবং এর ভর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এখন আমরা একটি নক্ষত্রের জালানী ফুরিয়ে গেলে কিভাবে এটি ব্ল্যাকহোলে পরিনত হয় তা জানবো।তার আগে একটি কথা বলে নেই, সব নক্ষত্রই কিন্তু ব্ল্যাকহোল হতে পারবেনা।সেগুলোর জালানী ফুরিয়ে গেলেও এগুলো চুপসে গিয়ে হোয়াইট ডর্ফ(White Dwarf) বা সাদা বামনে পরিনত হয় কিন্তু ব্ল্যাকহোল হয় না।মজার ব্যাপার হলো আমাদের সুর্য একটি মাঝারি সাইজের নক্ষত্র হলেও এটি কিন্তু কখনো ব্ল্যাকহোল হতে পারবেনা।জালানী শেষ হলে এটি প্রথমে রেড জায়ান্ট এবং পরে হোয়াইট ডর্ফে পরিনত হবে।

=>এখন আমরা নক্ষত্রের মৃত্যু প্রক্রিয়াটা জানবো। নক্ষত্রগুলোতে শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াটা আমরা জানি।মুলত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নক্ষত্রগুলোতে শক্তি উৎপাদন হয়। আমাদের সুর্যে প্রতি মুহুর্তে লক্ষ্য-কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশন বিক্রিয়া করে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিনত হচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত করছে।কিন্তু একটা সময় আসবে যখন এই হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে তখন সুর্যকে আর জ্বলজ্বল করতে দেখা যাবে না।ঠিক সুর্যের মতো মহাবিশ্বের অন্যান্য নক্ষত্রসমুহও একই উপায়ে শক্তি উৎপাদন করে।সব নক্ষত্রেরই প্রাথমিক জালানী হাইড্রোজেন।কিন্তু একসময় এই হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যায়।তখন বিভিন্ন ধরনের আকারের নক্ষত্রগুলো বিভিন্ন রুপ ধারন করে।নিচের চিত্রটি খেয়াল করুন।

 

=>যেসব নক্ষত্রের আকার আকার খুব ছোট যেমন আমাদের সুর্য,সেগুলোর জালানী শেষ হলে তারা White dwarf বা সাদা বামনে পরিনত হয়।

চিত্র:একটি হোয়াইট ডর্ফ।
চিত্র:একটি হোয়াইট ডর্ফ।

=>যেসব নক্ষত্রের আকার মোটামুটি বড় সেগুলো পরিনত হয় নিউট্রন স্টারে।চুপসে গেয়ে এর আকার হয় খুবই ছোট। একটি হোয়াইট ডর্ফের থেকেও ছোট। কিন্তু ভর হয় অনেক বেশি।এগুলো প্রায় শেষ পর্যায়ে সুপারনোভা বিস্ফোরন ঘটায়।

চিত্র:হোয়াইট ডর্ফ,নিউট্রন স্টার এবং পৃথিবীর আকারের তুলনা।
 চিত্র: একটি সুপারনোভা বিস্ফোরন যেরকম দেখায়।
চিত্র: একটি সুপারনোভা বিস্ফোরন যেরকম দেখায়।

এই বিস্ফোরনের ফরে যেই শক্তি উৎপাদিত হয় তার পরিমাণ কিন্তু অনেক অনেক বিশাল।যেহেতু এটা পারমাণবিক বিস্ফোরন তাই এখানে বস্তুর ভর শক্তিতে রুপান্তরিত হয়।

=>এতক্ষণ আমরা ছোট এবং মোটামুটি বড় নক্ষত্রের শেষ পরিনতি নিয়ে আলোচনা করছিলাম।এখন যদি নক্ষত্রটি অনেক বড় হয়?তার আকার যদি হয় আমাদের অতি পরিচিত সুর্যের চাইতে কয়েকগুন বেশি??তাহলে সেটির পরিনতি কি হবে?? সেটি ব্ল্যাকহোলে পরিনত হবে।আয়তন সংকুচিত হতে হতে এটির ব্যাসার্ধ হবে মাত্র কয়েক কিলোমিটার,কিন্তু ভর একই থাকবে।যাই এর মহাকর্ষ হবে অনেক বেশি।এতই বেশি যে এটি পরিনত হবে ব্ল্যাকহোলে।আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ব্ল্যাকহোল হলো স্টেলার ব্ল্যাকহোল। একেকটি স্টেলার ব্ল্যাকহোলের ভর হতে পারে সুর্যের ভরের প্রায় মাত্র ২০গুন কিন্তু ব্যাসার্ধ হয় মাত্র ১০ মাইলের মতো।আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এরকম ডজনখানেক ব্ল্যাকহোল আছে। এতক্ষণ আমরা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম।এখন আমরা ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত কিছু পরিভাষা জেনে নেই-

১।সিঙ্গুলারিটি:ব্ল্যাকহোলের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু।এই জায়গায় এসে স্থান-কাল(Space-Time) মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

২।ইভেন্ট হরাইজন বা দিগন্তরেখা:ব্ল্যাকহোলের চারপাশে এমন একটি বৃত্তাকার পথ যার বাইরে পর্যন্ত আপনি নিরাপদ।এটি হলো ব্ল্যাকহোলের বিশাল মহাকর্ষের শেষ সীমা।এই জায়গাটা আলোকিত দেখা যায় কারন কোনো আলো যদি ব্ল্যাকহোলে প্রবেশ করে তখন এটি এই জায়গাটায় ঘুরপাক খেতে থাকে ইভেন্ট হরাইজনকে The Point Of No Return বলা হয়।

৩।সোয়ার্জাস্কাইলড ব্যাসার্ধ:আলোক ফোটন কৃষ্ণবিবরের যে ব্যাসার্ধের বাইরে যেতে পারে না, তাকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ (ইংরেজি: Schwarzchild Radius) বলা হয়। প্রবর্তক কার্ল শোয়ার্জশিল্ড এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। M ভরের একটি বস্তুর ব্যাসার্ধ যদি 2GM/c^{2} হয়, যেখানে G হলো সার্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক এবং c হলো আলোর দ্রুতি, তাহলে এর থেকে কোন ফোটনই বেরিয়ে যেতে পারে না।

ব্ল্যাকহোল নিয়ে আজকের আলোচনা শেষ হলো।আগামী পর্বে বিভিন্ন ধরনের ব্ল্যাকহোল নিয়ে আলোচনা করবো।

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর:মহাকাশের মহাবিস্ময় পর্ব:১ পড়তে নিচে ক্লিক করুন।


ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর:মহাকাশের মহাবিস্ময় পর্ব:১

সর্বশেষ প্রকাশিত